গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music

গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music নিয়ে আজকের আলাপ। হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে অনেক গুলো গীত বা গানের ঘরানা ছিল। রাজা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার যুগ শেষ হবার পরে ঘরানাদার গান বাজনার প্রভাব কমতে শুরু করে। তাছাড়া বহু ঘরানার শিল্পীরা বাইরে প্রকাশ্যে গানবাজনা বা মেলামেশার কারণেও সঙ্গীতরীতি অনেক খানি মিশে গেছে। তবে এখনো কিছু ঘরানা জীবিত আছে এবং সেই ঘরানার ছাত্র খলিফাগন ঘরানার গানবাজনা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music

সেইসব ঘরানার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বিবর্তন নিয়ে আজকের আয়োজন। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ঘরানার মধ্যে মোটামুটিভাবে আটটি ঘরানার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে সংগীতগুণীজন ও গবেষকবৃন্দ মনে করেন। সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো। আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে।

Table of Contents

অতরৌলি ঘরানা [Atrauli Gharana]:

অতরৌলি ঘরানা  সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের অতরৌলি ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

আগ্রা ঘরানা [ Agra Gharana ] :

আগ্রা ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের আগ্রা ঘরানার আর্টিকেলটি পড়ুন।

আমির খসরু ঘরানা [ Amir Khusro Gharana ]:

আমির খসরু ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের আমির খসরু ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

আল্লাদিয়া ঘরানা [ Alladiya Gharana ]:

আল্লাদিয়া ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের আল্লাদিয়া ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

কালপি ঘরানা [ Kalpi Gharana ]:

এই ঘরানার সুবিখ্যাত ধারক ও বাহকবৃন্দের মধ্যে ওস্তাদ আব্দুল গনি খাঁ সাহেবের শিষ্য লক্ষ্ণৌর বিদগ্ধ সাধকশিল্পী ওস্তাদ ইউসুফ আলী খাঁ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তিনি জয়পুরের ওস্তাদ আবিদ হোসেনের কাছেও সংগীত বিষয়ে তালিম গ্রহণ করেন। ‘কালপি ঘরানা’র অন্যতম ধারক ওস্তাদ ইউসুফ আলী খাঁ সাহেবের শিষ্যবৃন্দের মধ্যে ইলিয়াস খাঁ, শশধর দত্ত, বিমল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য নাম।

গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music

কিরানা ঘরানা [ Kirana Gharana ] :

কিরানা ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের কিরানা ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

খুরজা ঘরানা [ Khurja Gharana ]:

খুরজা ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের খুরজা ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

গয়া ঘরানা [ Goya Gharana ] :

গয়া ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের গয়া ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

গোয়ালিয়র ঘরানা [ Gwalior Gharana ]:

গোয়ালিয়র ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের গোয়ালিয়র ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

জয়পুর ঘরানা [ Jaipur Gharana ]:

জয়পুর ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের জয়পুর ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

ডাগর ঘরানা [ Dagar Gharana ]:

ডাগর ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের ডাগর ঘরানা’র আর্টিকেলটি পড়ুন।

তানসেন ঘরানা [Tansen Gharana ]:

তানসেন ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের তানসেন ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

দিল্লি ঘরানা [ Delhi Gharana ]:

দিল্লি ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের দিল্লি ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

পাতিয়ালা ঘরানা [ Patiala Gharana ]:

পাতিয়ালা ঘরানা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের পাতিয়ালা ঘরানা‘র আর্টিকেলটি পড়ুন।

গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music

প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানা [ Prashaddu Gharana ]:

সংগীতের পীঠস্থান বারানসিতে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে তৎকালীন প্রসিদ্ধ ও কুশলী সংগীতপ্রতিভা হরিপ্রসাদ মিশ্র এবং মনোহর মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয় প্রবর্তন করেন এই ঘরানা। প্রবর্তক দুই ভাইয়ের নামানুসারেই ঘরানাটির নামকরণ করা হয় ‘প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানা’। তাল ও লয়ের প্রতি বিশেষ ঝোঁকসহ কণ্ঠ এবং যন্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই অপূর্ব নান্দনিকতা প্রদর্শন প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানা সংগীতশৈলীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল।

বারানসিতে উদ্ভব হলেও এই ঘরানার প্রবর্তক ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমেই এর যথার্থ বিকাশ সাধিত হয় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের উত্তরসূরি শিষ্য ও প্রশিষ্যবৃন্দের মাধ্যমে প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানার ঐতিহ্য সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘরানার বাঙালি সংগীতগুণীজনদের মধ্যে শিল্পী মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিল্পী নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রমুখ বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

প্রসদ্দু-মনোহর ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Prashaddu Manahar Gharana ]:

  • উচ্চাঙ্গ ও লঘু প্রকৃতির গীত
  • লয়কারী ও সপাট তানের দক্ষতা
  • বৈচিত্র্যময় বোলতান
  • সুর মাধুর্যপূর্ণ খোলা আওয়াজ
  • জোরদার বোলের বাদনশৈলীর প্রয়োগ

বান্দা ঘরানা [ Banda Gharana ]:

‘বান্দা ঘরানা’র ধারক ও বাহক বিদগ্ধ সংগীতগুণীজন ওস্তাদ সাজ্জাদ মহম্মদের কাছে বিষ্ণুপুরের রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল চন্দ্র নাগ, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট সংগীতসাধকবৃন্দ তালিম গ্রহণ করেন। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্য হলেন সত্য কিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার গোপালচন্দ্র নাগের শিষ্য হলেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র স্বনামখ্যাত মনিলাল নাগ।

বান্দা ঘরানার বিশিষ্ট বাদক ওস্তাদ গুলাম মহম্মদের কাছে তালিম লাভ করেন মুহম্মদ খাঁ। ওস্তাদ মহম্মদ খাঁর শিষ্য বামাচরণ শিরোমণি নিজ পুত্র জিতেন্দ্রনাগ ভট্টাচার্যকে এই ঘরানার সংগীতশৈলীসমৃদ্ধ শিক্ষা প্রদান করেন। গুণী সেতারশিল্পী জিতেন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর অর্জিত সংগীতভাণ্ডার উজাড় করে পুত্র লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যকে করে তোলেন পরিপূর্ণ।

স্বনামখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত সেতারশিল্পী লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের কাছে তালিম গ্রহণ করেন অপরেশ চট্টোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পী। এভাবেই গুরু-শিষ্য এবং বংশপরম্পরায় বান্দা ঘরানার সংগীতশৈলী তার উৎকর্ষ ও নান্দনিকতা প্রস্ফুটিত করতে থাকে।

বারানসি মিশ্র ঘরানা [ Banaras Gharana Mishra ]:

ঋদ্ধ সংগীতজ্ঞ বুদ্ধ মিশ্রকে বলা হয় ‘বারানসি মিশ্র ঘরানা’র প্রবর্তক। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে সংগীতের পীঠস্থান বারানসিতে তিনি এই ঘরানার প্রবর্তন করেন। টপ্পা ও খেয়াল গানের চমৎকার কুশলী গায়নশৈলীর সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র সারেঙ্গির অসাধারণ বাদননৈপুণ্যের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি হয় বলেই এই ঘরানার নাম হয়েছে মিশ্র ঘরানা।

সেইসঙ্গে উৎপত্তিস্থলের নাম জুড়ে দিয়ে এই বিশেষ শৈলীটি বারানসি মিশ্র ঘরানা নামেই সংগীতভুবনে পরিচিতি লাভ করেছে। পরবর্তীকালে তবলাবাদনের বিশেষ সৌকর্য যুক্ত হয়ে এর নান্দনিকতা আরো বৃদ্ধি পায়। ঋদ্ধ সংগীতগুণীজন বুদ্ধ মিশ্রের সুযোগ্য পুত্র বেচু মিশ্রের মাধ্যমে এই ঘরানা বাংলায় প্রচার ও প্রসার লাভ করে। বারানসি মিশ্র ঘরানার বিশেষ খ্যাতিমান বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে পণ্ডিত রামপ্রসাদ, শরৎ চট্টোপাধ্যায়, রামনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বারানসি মিশ্র ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Banaras Mishra Gharana ]:

  • মিশ্র রাগের সৃষ্টি ও সুন্দর প্রয়োগ
  • উচ্চাঙ্গের লয়কারীর কাজ
  • টপ্পা ও ছোট খেয়ালে বিশেষ দক্ষতা
  • তান ও বোলতানে চমৎকার নৈপুণ্য
  • সুরেলা খোলা আওয়াজ ও জোরদার বোলের বাদন

বিষ্ণুপুর ঘরানা [ Bishnupur Gharana ]:

সংগীতজগতের মুকুটহীন নৃপতি মিয়া তানসেনের বংশধর ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেব নিজ নৈপুণ্যে যে নতুন গায়নশৈলী সৃষ্টি করেন তাকেই বলে ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’ । বিষ্ণুপুরের মল্লবংশীয় মহারাজ রঘুপতি সিংহ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেবকে সভাগায়কের পদ অলংকৃত করার জন্য নিমন্ত্রণ করে আনেন। তৎকালীন বাংলায় সংগীতচর্চার পীঠস্থান ছিল বিষ্ণুপুর। ওস্তাদজির কর্মস্থলের নামেই নতুন সংগীতশৈলীর প্রবর্তন হয় বিষ্ণুপুর ঘরানা নামে।

আবার কেউ কেউ বলেন, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতাপশালী সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সংগীতজীবীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বর্ণনাতীত দুর্দশা মোকাবিলা করতে হয়। সে সময় সেনি ঘরানার প্রসিদ্ধ ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ বিষ্ণুপুররাজ রঘুনাথ সিংহের দরবারে সভাগায়কের স্থান লাভ করেন। তখন থেকেই ওস্তাদজির শিষ্যপরম্পরা বিষ্ণুপুর ঘরানার জন্ম হয়। আর সেনি ঘরানার ওস্তাদ বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎস হওয়ার কারণেই এ ঘরানায় সেনি ঘরানার বৈশিষ্ট্য ও প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।

কিন্তু স্বামী প্রজ্ঞানন্দের তথ্যভিত্তিক যুক্তি মতে, অন্যতম সংগীতগুণীজন পণ্ডিত রামশংকর ভট্টাচার্য হচ্ছেন বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রথম ও প্রধান রূপকার। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছেন যে, পণ্ডিত রামশংকর ভট্টাচার্য বাহাদুর খাঁ সাহেবের শিষ্য ছিলেন না এবং আগ্রা, মথুরা ও বৃন্দাবন অঞ্চলের অধিবাসী এক হিন্দু সংগীতগুণীজনের কাছ থেকে পাওয়া সংগীতসম্পদ হতেই বিষ্ণুপুর ঘরানার জন্ম। এই ঘরানার সূচনা ও সম্প্রসারণ বাংলার সংগীতজগতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এর প্রভাবেই বাংলায় ধ্রুপদচর্চার প্রসার ঘটে। কেননা বিষ্ণুপুরে তখন প্রধানত ধ্রুপদসংগীতেরই সমধিক চর্চা হতো।

বাংলা ভাষায় ধ্রুপদচর্চার ইতিহাসে বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতশৈলী এ অঞ্চলেই প্রথম এবং উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ ভাবগাম্ভীর্যে সমুন্নত এবং তালের ছন্দ বিভাগেও যথেষ্ট স্বকীয়তা রয়েছে। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সংগীতজ্ঞ গুণীজনেরা বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং এই ঘরানা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

বিষ্ণুপুর ঘরানার ধারক ও বাহক সংগীতগুণীজনদের মধ্যে পণ্ডিত রামশংকর ভট্টাচার্য, গঙ্গাধর চক্রবর্তী, অনন্তলাল চক্রবর্তী, যদু ভট্ট, পণ্ডিত ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী, জ্ঞানেন্দ্র প্রসাদ গোস্বামী এবং অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারপুত্র গোপেশ্বর, রামপ্রসন্ন, সুরেন্দ্রনাথ ও রামকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আধুনিককালে সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর, জগৎ চাঁদ গোস্বামী, বিপিন বিহারী চক্রবর্তী, সত্য কিংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ গুণীজন এই ঘরানার যথেষ্ট সমৃদ্ধি সাধন করেছেন।

গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music

বিষ্ণুপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Bishnupur Gharana ] :

  • ধ্রুপদ গায়নে বিশেষ দক্ষতা
  • ধ্রুপদাঙ্গ খেয়াল গায়নের প্রবণতা
  • তান ও বোলতানে পারঙ্গমতা
  • কঠিন লয়কারীর প্রাধান্য
  • ছন্দ প্রকরণে দক্ষতা

বেতিয়া ঘরানা  [ Betiya Gharana ]:

বিহারের বেতিয়া রাজ্যের রাজদরবারকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ‘বেতিয়া ঘরানা’ উদ্ভাবিত হয়। তখনকার সময়ে হিন্দু ও মুসলমান রাজন্যবর্গের মধ্যে বেতিয়া মহারাজ আনন্দকিশোর ধ্রুপদ গানের শিল্পী হিসেবে অসামান্য খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট ধ্রুপদ গান ছিল সৌকর্যগুণে নন্দিত ও শ্রুতিমধুর। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেনের পুত্রবংশীয় রবাব শিল্পীগণ নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে কাশীধামে এসে বসবাস শুরু করেন।

সেনি ঘরানার প্রখ্যাত ওস্তাদ প্যারা খাঁ মহারাজা আনন্দকিশোরের রাজসংগীতগুরু এবং সভাসংগীতজ্ঞ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে বেতিয়ারাজের গায়নশৈলীতে সেনি ঘরানার ছায়া কমবেশি পরিলক্ষিত হতো। এজন্য অনেক সংগীতগুণীজন বেতিয়া ঘরানাকে মূলত সেনি ঘরানা থেকে উদ্ভূত এক বিশেষ সংগীতশৈলী বলে মনে করে থাকেন। সংগীতাচার্য রাজা বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁর Hindusthani Music and Mian Tansen গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে,

‘লক্ষ্ণৌয়ের হায়দার খাঁ, সেনি ঘরানার শিষ্যবৃন্দ এই ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। এই ঘরানার সহিত কল্লির মুসলমান ওস্তাদদের নামও জড়িত।’

তবে যে যা-ই মনে করুন না কেন, স্বনামখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী রাজা আনন্দকিশোরের উদ্যোগেই ‘বেতিয়া ঘরানা’ সৃষ্টি হয়। বেতিয়ারাজ স্বয়ং কথক ব্রাহ্মণদের সংগীতশিক্ষা প্রদান করতেন। বেতিয়া ঘরানার বিশিষ্ট ধারক ও বাহকগণ মহারাজার শিষ্যকুল হতেই এসেছে। প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ বখতাওরজি, শিবনারায়ণ মিশ্র, গুরুপ্রসাদ মিশ্র এই ঘরানার অন্যতম সংগীতগুণীজন। তাঁদের শিষ্যবৃন্দের মধ্যে কলকাতার খ্যাতিমান ধামারগায়ক বিশ্বনাথ রাও, শ্যামসুন্দর মিশ্র, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ সংগীতগুণীজনের নাম উল্লেখযোগ্য।

বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞ শিবনারায়ণ মিশ্র ও গুরুপ্রসাদ মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমেই বেতিয়া ঘরানা বাংলাভূমিতে প্রচার ও প্রসার লাভ করে। পরবর্তী সময়ে সংগীত স্রোতধারায় বাংলাই হয়ে ওঠে বেতিয়া ঘরানার ধারক ও বাহক। এই ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীবৃন্দের মধ্যে লালচাঁদ বড়াল ও সতীশচন্দ্র দত্ত সংগীতভুবনে হয়ে আছেন নন্দিত।

বেতিয়া ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Betiya Gharana ] :

  • স্বরের সহজসাধ্য ও সুন্দর প্রয়োগ
  • সুর মাধুর্যপূর্ণ সুস্পষ্ট বাণী
  • রাগরূপ বিস্তারে চমৎকারিত্ব
  • ধ্রুপদী মেজাজের সঙ্গে শ্রুতিমাধুর্যের সমন্বয়
  • খোলা ও মধুর আওয়াজের প্রয়োগ

দ্বারভাঙ্গা ঘরানা [ Darbhanga Gharana ]:

অতীতে ধ্রুপদ গান যথেষ্ট শ্রোতানন্দিত হয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করায় একে কেন্দ্র করে বেশকিছু ঘরানার উদ্ভব হয়েছিল। অবশ্য কালের আবর্তে সেগুলোর মধ্য থেকে অনেকগুলো আবার হারিয়েও যায়। ধ্রুপদ গানের আসরে সে-সময় ‘দ্বারভাঙ্গা ঘরানা’ সংগীতরসিক মহলে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে স্বীকৃত ও আদৃত ছিল। এই ঘরানার ধারক ও বাহকদের মধ্যে শিল্পী রামেশ্বর পাঠক এবং শিল্পী বলরাম পাঠক তৎকালীন সময়ে বিশেষ খ্যাতিমান ছিলেন বলে জানা যায়।

রামপুর ঘরানা [ Rampur Gharana ]:

রামপুর রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতায় উনিশ শতকের মধ্যভাগে ‘রামপুর ঘরানা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাব বাহাদুর কলবে খাঁ নিজেও ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ এবং বহু বাদ্যযন্ত্র বাদনে বিশেষ পারদর্শী। বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আহমদ আলী খাঁ রামপুর ঘরানার সংগীতশিল্পী হিসেবে ছিলেন খ্যাতিমান। কোনো কোনো সংগীতগুণীজন রামপুর ঘরানার সংগীতশৈলীকে ‘আহমদ আলী খাঁ’ ঘরানা নামেও উল্লেখ করে থাকেন। তন্ত্রবাদ্যের ক্ষেত্রে এই ঘরানা যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল।

সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেনের পুত্রবংশীয় ওস্তাদ বাহাদুর সেন খাঁ সাহেবের অন্যতম শিষ্য হলেন রামপুরাধিপতির ভাই সংগীতজ্ঞ নবাব হায়দার আলী খাঁ। গুরুজির কাছে তাঁর আপন ভাইয়ের নাতি ওয়াজির খাঁ ছোটবেলা থেকেই সংগীতের তালিম গ্রহণ করতেন। মাত্র বারো বছর বয়সে গুরুজি ইহলোক ত্যাগ করলে নিজ পিতা সুপ্রসিদ্ধ বীণাশিল্পী ওস্তাদ আমির খাঁর কাছে চলছিল ওয়াজিরের সংগীত সাধনা। এর কিছুদিন পর বাবার অকালপ্রয়াণ হলে নবাব হায়দার আলী খাঁ সাহেবের কাছে তিনি সংগীতশিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন।

ত্রিপুরা রাজ্যের সভাবাদক নিজ মামা বিখ্যাত রবাবশিল্পী কাসেম আলী খাঁ সাহেবের কাছে রবাব ও সুরশৃঙ্গার এবং পিতৃবংশীয় শ্রেষ্ঠ গায়ক ওস্তাদ বাকরালি খাঁর কাছে তিনি খেয়াল গানের শিক্ষা লাভ করেন। এভাবে সংগীতবিদ্যা অর্জনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ নিজেও একদিন হয়ে ওঠেন সে যুগের ভারতশ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ।

রামপুর রাজদরবারের এই সংগীতগুণীজনদের সকলেই ছিলেন তৎকালীন সময়ের সুপ্রসিদ্ধ ও খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ। রামপুর নবাবের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় সংগীতের নানা বিভাগে বহু শিষ্যকে শিক্ষা প্রদানের সুব্যবস্থা ছিল সেখানে।

প্রখ্যাত সরোদশিল্পী ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ, আব্দুর রহিম খাঁ, তারাপদ ঘোষ, নাসির আলী, মোহাম্মদ হোসেন, তারাপ্রসাদ রায়, প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে, যাদবেন্দ্র মহাপাত্র, সৈয়দ ইব্বন আলী, উপমহাদেশের অন্যতম গায়িকা শ্রীজ্ঞান এবং বাংলার গৌরবময় সংগীত পরিবারের অন্যতম দুই দিকপাল সংগীতরত্ন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও বিদগ্ধ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ রামপুর ঘরানার সংগীতধারাকে হৃদয়ে লালন করে সংগীতশিক্ষা লাভ করেন।

রামপুর রাজদরবারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় স্বনামধন্য এই সংগীতগুণীজনদের মাধ্যমে রামপুর ঘরানা ভারতবর্ষ তথা সমগ্র সংগীতবিশ্বে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সংগীতরত্ন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের অভূতপূর্ব সংগীতনৈপুণ্য এবং তাঁর শিষ্য ও প্রশিষ্যবৃন্দের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি বিশ্বসংগীত দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। বিশ্বখ্যাত সরোদশিল্পী যিন্দা হোসেন ও সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করও ছিলেন রামপুর ঘরানার অনুসারী।

ওস্তাদ দবির খাঁ সাহেবের মাধ্যমেই বাংলার সংগীত আসরে এই ঘরানা প্রচলিত হয় এবং ব্যাপক প্রসার লাভ করে। অবশ্য সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেন বংশীয় সেরা গুণীজনদের বিশেষ অবদানে রামপুর ঘরানার উদ্ভব হয় বলেই অনেকে মনে করেন। হয়তো সেজন্যই কোনো কোনো গুণীজন রামপুর ঘরানাকে সেনি ঘরানার রূপান্তর বলে অভিহিত করে থাকেন।

রামপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Rampur Gharana ] :

  • পদ্ধতিগত সম্পূর্ণতা
  • খোলা আওয়াজের প্রয়োগ
  • তান প্রয়োগে অসাধারণ নৈপুণ্য
  • তিন সপ্তকেই সহজ যাতায়াত
  • ধ্রুপদী মেজাজের সঙ্গে শ্রুতিমাধুর্যের সমন্বয়

সহসবান ঘরানা [ Sahaswan Gharana ]:

স্বনামখ্যাত সংগীতগুরু ওস্তাদ নখন পীর বখস সাহেবের পুত্রবংশীয় নাতি এবং ওস্তাদ হদ্দু খাঁ সাহেবের জামাতা ওস্তাদ ইনায়েত খাঁ সাহেব ‘সহসবান ঘরানা’র ধারক ও বাহক হিসেবে অত্যন্ত প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেন বংশীয় উজ্জ্বল সংগীত নক্ষত্র ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেবের কাছেও তিনি সংগীতশিক্ষা লাভ করেন। ফলে তাঁর সংগীতশৈলীতে গোয়ালিয়র ও বিষ্ণুপুর ঘরানার মিলিত সৌন্দর্য অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে পরিলক্ষিত হতো।

ওস্তাদ ইনায়েত খা পরবর্তী শিষ্যপরম্পরায় সহসবান ঘরানার বিদগ্ধ শিল্পীবৃন্দের মধ্যে রামকৃষ্ণ বঝে বুয়া, মুস্তাক হোসেন খাঁ, কুমার গান্ধর্ব, বি আর দেওধর প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম।

সহসবান ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Sahaswan Gharana ] :

  • তান ও বোলতানের পারঙ্গমতা
  • খোলা আওয়াজের প্রয়োগ
  • ধ্রুপদিয়া শৈলীর দক্ষতা
  • ছন্দ প্রকরণে নৈপুণ্য
  • স্বর বিস্তারে কুশলতা

 

YaifwwriN4BzRFCyqbslL4 গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সাহারানপুর ঘরানা [ Saharanpur Gharana ]:

বাহাদুর খা জাফরের দরবারি গায়ক সুফি সাধক ওস্তাদ মহম্মদ জমা ছিলেন ‘সাহারানপুর ঘরানা’র ধারক ও বাহকদের মধ্যে অন্যতম। সংগীতসম্রাট মিয়া তানসেনের কন্যাবংশীয় সংগীতজ্ঞ নির্মল শাহের কাছে তিনি সংগীতশিক্ষা লাভ করেন। তবে এই ঘরানার প্রসঙ্গে প্রথমেই আসে ইন্দোর ঘরানার সংগীতজ্ঞ মুরাদ খাঁ সাহেবের অন্যতম শিষ্য ওস্তাদ বাবু খাঁ সাহেবের নাম।

সাহারানপুর ঘরানার সংগীতশৈলী প্রচার ও প্রসারে স্বনামখ্যাত ওস্তাদ মহম্মদ জমা, ওস্তাদ বাবু খাঁ এবং তাঁর শিষ্য ও প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আব্দুল হালিম জাফর খাঁ সাহেবের অবদান সর্বোচ্চ। এই ঘরানার প্রসিদ্ধ সংগীতশিল্পীবৃন্দের মধ্যে মৌলা বক্স, মিয়া কালু, বহরাম খাঁ, অলাবন্দে খাঁ, বন্দে আলী খাঁ, জাকিরুদ্দিন খাঁ এবং ধ্রুপদ গায়ক রহিমুদ্দীন খাঁ, আমিনুদ্দীন ও মৌজুদ্দীন ডাগর প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সাহারানপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্য [ Speciality of Saharanpur Gharana ] :

  • তৈয়ারী ও স্বরের রঢ়ত
  • লয়কারীর দক্ষতা
  • আলাপকারী ও বাদনশৈলীতে ধ্রুপদ, খেয়াল ও ঠুংরি গানের প্রভাব

আরও পড়ুন:

14 thoughts on “গীত ঘরানা, কণ্ঠশিল্পী বা গানের ঘরানা [ সঙ্গীতের ঘরানা ] Vocal Gharana of Music”

Leave a Comment