তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য একজন বিখ্যাত বাঙালি সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। তন্ত্রসাধক পরিবার থেকে সরোদশিল্পের অপরিচিত আঙিনায় পা রেখেছিলেন তিনি। সারা ভারতে তখন সরোদ বাজাতেন মাত্র ছ’জন। সাধারণ মানুষ সরোদের নামও শোনেনি। বড়বাজারের শিবঠাকুরের গলির ৩১ নম্বর বাড়ির মেজ ছেলে যে সেই বাজনা নিয়ে ভারতজোড়া তথা জগৎজোড়া নাম করবেন, এমনটা কেউই ভাবেননি। তিনি, তিমিরবরণ ভট্টাচার্য, প্রথম নামেই বিখ্যাত। বিদেশি যন্ত্র ব্যবহার করে খাঁটি ভারতীয় অর্কেস্ট্রার জন্মদাতা হিসেবে আজও তিনি পরম শ্রদ্ধেয়, স্মরণীয়। এক অর্থে বলা যায়, ভারতীয় ফিল্ম মিউজিককে থিয়েটারের প্রভাবমুক্ত করে তাকে এক অন্য মাত্রায় বেঁধে দিয়েছিলেন তিমিরবরণ।

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য  এর বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। পরিবারে প্রায় সকলেই সংস্কৃতে পণ্ডিত। জ্ঞানেন্দ্রনাথের তিন ছেলে– বড় মিহিরকিরণ, মেজ তিমিরবরণ ও ছোট শিশিরশোভন। তবে ভট্টাচার্য পরিবারের খ্যাতি তখন সঙ্গীতের চেয়ে তান্ত্রিক সাধনমার্গের কারণেই বেশি। পাথুরিয়াঘাটার রাজপরিবার ছিলেন ভট্টাচার্যদের মন্ত্রশিষ্য। সে বাড়ির জামাই বিখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী আশুবাবু, পাখোয়াজশিল্পী নগেন দেব, খেয়ালশিল্পী রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী আসতেন শিবঠাকুরের গলিতে। তাঁদের হাতেই ভাইদের তালিম শুরু। দাদা মিহিরকিরণ বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতেন। খুব অল্পবয়সে পিতৃহারা হয়ে দাদাকেই পিতৃসম জ্ঞান করতেন তিমিরবরণ। দাদার সঙ্গীতচর্চার প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে অনেকখানি।

 

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

 

তিমিরবরণ ভট্টাচার্যর পড়াশোনা শুরু হয় ওরিয়েন্টাল সিভিল স্কুল ও সিটি ট্রেনিং স্কুলে। ১৯১৫ সালে ক্ল্যারিওনেটশিল্পী রাজেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। সেই সময়ই একদিন ব্যাঞ্জো সারাতে চিৎপুর রোডে বাজনার কারিগর গোবর্ধনের কাছে যান তিমিরবরণ। তাঁর হাতে ব্যাঞ্জো দেখে গোবর্ধন হেসে ফেলে বলেন, ‘বাবু, এ সব খেলনা যন্ত্র কেউ বাজায় নাকি? আপনি বরং সরোদ বাজান!’ তিমিরবরণ অবাক। এ যন্ত্রের নামও শোনেননি তিনি। দাদা মিহিরকিরণকে টানতে টানতে দোকানে নিয়ে গেলেন নতুন যন্ত্র দেখাতে। তাঁরও সেই প্রথম সরোদ চাক্ষুষ করা! কারণ আর কিছুই নয়, সেই বিশের দশকে ভারতে মাত্র ছ’জন ওই যন্ত্র বাজাতেন। ফিদা হুসেন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল্লা খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, করমতুল্লা খাঁ এবং আমির খাঁ। ফলে সরোদ দেখে, তার আওয়াজ শুনে দুই ভাই মুগ্ধ।

এরপর তিমিরবরণ ভট্টাচার্য গোঁ ধরলেন এই যন্ত্রই শিখবেন। গুরু কোথায়? গোবর্ধনই বাতলে দিলেন। তিনি যে সরোদটি বানাচ্ছিলেন, তা ছিল উস্তাদ আমির খাঁ সাহেবের, যিনি তখন মেছোবাজারে থাকতেন। তাঁর কাছেই শিক্ষা শুরু হয়। গোড়ায় স্থির হয়েছিল তিনি সপ্তাহে দু’দিন করে আসবেন। কিন্তু ছাত্রের আকুলতা, ক্ষমতা আর অধ্যবসায় দেখে খাঁ সাহেব রোজ দুবেলা শেখাতে আসতে শুরু করলেন। তিমিরবরণের নাতনি এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন,

‘বিকেল পাঁচটা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তালিম চলে। মাঝে শিষ্যই সাজিয়ে দেন তামাক, খাস ফৌজদারি বালাখানা থেকে আনা। আমির খাঁ নিজের সরোদটিও রেখে গেলেন শিষ্যের বাড়িতে। টানা পাঁচ বছর এমনটা চলতে থাকল। এমনও দিন গিয়েছে, যখন কলকাতা শহর বৃষ্টিতে ভাসছে। কিন্তু সরোদ শিক্ষায় খামতি নেই। কারণ, বুক সমান জল ডিঙিয়ে ততক্ষণে দরজায় টোকা দিচ্ছেন ওস্তাদজি, স্বয়ং আমির খাঁ।’

তিমিরবরণের বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। পরিবারে প্রায় সকলেই সংস্কৃতে পণ্ডিত। জ্ঞানেন্দ্রনাথের তিন ছেলে– বড় মিহিরকিরণ, মেজ তিমিরবরণ ও ছোট শিশিরশোভন। তবে ভট্টাচার্য পরিবারের খ্যাতি তখন সঙ্গীতের চেয়ে তান্ত্রিক সাধনমার্গের কারণেই বেশি। পাথুরিয়াঘাটার রাজপরিবার ছিলেন ভট্টাচার্যদের মন্ত্রশিষ্য। সে বাড়ির জামাই বিখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী আশুবাবু, পাখোয়াজশিল্পী নগেন দেব, খেয়ালশিল্পী রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী আসতেন শিবঠাকুরের গলিতে। তাঁদের হাতেই ভাইদের তালিম শুরু। দাদা মিহিরকিরণ বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতেন। খুব অল্পবয়সে পিতৃহারা হয়ে দাদাকেই পিতৃসম জ্ঞান করতেন তিমিরবরণ। দাদার সঙ্গীতচর্চার প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে অনেকখানি।

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

তিমিরবরণ ভট্টাচার্যর পড়াশোনা শুরু হয় ওরিয়েন্টাল সিভিল স্কুল ও সিটি ট্রেনিং স্কুলে। ১৯১৫ সালে ক্ল্যারিওনেটশিল্পী রাজেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। সেই সময়ই একদিন ব্যাঞ্জো সারাতে চিৎপুর রোডে বাজনার কারিগর গোবর্ধনের কাছে যান তিমিরবরণ। তাঁর হাতে ব্যাঞ্জো দেখে গোবর্ধন হেসে ফেলে বলেন, ‘বাবু, এ সব খেলনা যন্ত্র কেউ বাজায় নাকি? আপনি বরং সরোদ বাজান!’ তিমিরবরণ অবাক। এ যন্ত্রের নামও শোনেননি তিনি। দাদা মিহিরকিরণকে টানতে টানতে দোকানে নিয়ে গেলেন নতুন যন্ত্র দেখাতে। তাঁরও সেই প্রথম সরোদ চাক্ষুষ করা! কারণ আর কিছুই নয়, সেই বিশের দশকে ভারতে মাত্র ছ’জন ওই যন্ত্র বাজাতেন। ফিদা হুসেন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল্লা খাঁ, হাফিজ আলি খাঁ, করমতুল্লা খাঁ এবং আমির খাঁ। ফলে সরোদ দেখে, তার আওয়াজ শুনে দুই ভাই মুগ্ধ।

১৯২৫ নাগাদ তিমিরবরণ ভট্টাচার্য খবর পেলেন গৌরীপুরের রাজবাড়িতে মাইহার থেকে আসছেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ। এসরাজশিল্পী শীতল মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে তিন ভাই একসঙ্গে সাক্ষী থাকলেন এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার। সামনে থেকে শুনলেন বাবা আলাউদ্দিনের সরোদবাদন। আর সেই সন্ধেই পালটে দিল তিমিরবরণের জীবনের অভিমুখ। সরাসরি বাবা-জির কাছে গিয়ে জানালেন, আপনার কাছে বাড়া বাঁধতে চাই। তিনি পাত্তা দিলেন না। কিন্তু তিমিরবরণ ছাড়ার পাত্র নয়। অপারগ হয়ে তাঁর কাছে বাজনা শুনতে চাইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। মনপ্রাণ ঢেলে বাজালেন তিমিরবরণ। অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন বাবাজি কিন্তু শেখাতে রাজি হলেন না। শেষমেশ গৌরীপুরীরের রাজকুমারর উপরোধে তিনি নরম হলেন। মাইহারে এসে থাকার অনুমতি দিলেন তিমিরবরণকে। সেই শুরু হল তাঁর জীবনের এক অন্য অধ্যায়। কলকাতার পাঠ চুকিয়ে নির্জন মাইহারে পাড়ি দিলেন তিমিরবরণ। সে সময়ের কথা লিখেছেন তিমিরবরণের নাতনি।

“কিছু দিন থাকা-খাওয়া ওস্তাদজির বাড়িতেই। পরে আলাউদ্দিনের আবেদনে মাইহারের মহারাজা একটি মন্দিরে তিমিরবরণের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানেই একটি ইকমিক কুকারে রান্না করতেন ঠাকুরদা। সেই সময়ে প্রতি মাসে কলকাতায় ভাইকে কুড়ি টাকা পাঠাতেন তিনি। …তবে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঠাকুরদার প্রথম কাজটি ছিল শিক্ষাগ্রহণ। বাবার কাছে শিক্ষাগ্রহণও যে খুব একটা সহজ নয়। আলাউদ্দিন নাকি মাত্র এক বার শিক্ষার্থীকে বাজিয়ে শোনাতেন, তাও মিনিট ১৫। সেটাই মনে রেখে ঠিকঠাক বাজাতে হবে। না হলে জুটতে পারে হুঁকো হাতে বাবার মার। ঠাকুরদার অবশ্য সাধকের নিষ্ঠা। গ্রীষ্মে রাতভর বাজাতেন। শীতে রাত তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে টানা সাত ঘণ্টা চলত অভ্যেস।…”

আস্তে আস্তে খ্যাতি পেতে শুরু করলেন তিমিরবরণ। স্বয়ং ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর আমন্ত্রণে চা-চক্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি বাজনা শুনতে চাইলেন। বলাই বাহুল্য, এ সুযোগ ছাড়েননি তিমিরবরণ। কবিকে শোনালেন ‘পুরিয়া ধনেশ্রী’। মুগ্ধ কবি শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানালেন শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। বললেন, ‘তোমার মতো লোক আমার দরকার’। তাছাড়াও কখনও কাজি নজরুল, কখনও দিলীপকুমার রায়, কখনও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কখনও বা সত্যেন্দ্রনাথ বসু… তিমিরবরণের বাজনা নাড়িয়ে দিয়েছিল সকলকে।

 

তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক

 

আরও দেখুন:

1 thought on “তিমিরবরণ ভট্টাচার্য | সরদ বাদক, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক”

Leave a Comment