গজল [ Ghazal ] গজল গান ও কবিতা – সঙ্গীত শৈলী [ Music Genre ]

গজল গান  ,গজল [ Ghazal ] গান আবার কবিতাও। সহজ কথায় ফারসি ও উর্দু ভাষায় রচিত একপ্রকার শৃঙ্গার রসাত্মক ক্ষুদ্র গানকে বলা হয় গজল [ Ghazal ]। এ ধারার গানে একমাত্র উপজীব্য হচ্ছে প্রেম। প্রেমিক প্রেমিকাকে উদ্দেশ করে কিংবা প্রেমিকা প্রেমিককে উদ্দেশ করে এই গান গেয়ে থাকেন, যা পরস্পরের কাছে অনাগত।

তবে উর্দুর এক বিশেষ ধরণের কবিতাকেও গজল [ Ghazal ] বলা হয়। গুরুকুল প্রমুখ জনাব সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর গজলের বিষয়ে বলেছেন “গজল এক ধরনের উর্দু কবিতা, বা জোড়া দেয়া কবিতার সমগ্র। এই কবিতাগুলো যখন সুর মিশিয়ে গাওয়া শুরু হলো, তখন সেই গানের নামও হল গজল [ Ghazal ]।

গজল [ Ghazal ] গজল গান ও কবিতা – সঙ্গীত শৈলী [ Music Genre ]

ওস্তাদ মেহেদি হাসানের বিখ্যাত গজল [ Ghazal ] “জিন্দেগী মে তো সাবহি”:

তবে সৃষ্টিকর্তার প্রেমে মগ্ন হয়েও এই গান রচিত এবং গাওয়া হয়ে থাকে। এমনকি অন্যান্য বিষয়বস্তু নিয়েও এই গান রচিত হতে পারে। প্রচলিত আছে যে, দার্শনিক ও সুগায়ক হজরত আমির খসরু সর্বপ্রথম পারস্যের গীতশৈলী অনুসরণে সৃষ্ট গজল [ Ghazal ] গান পাঠান নবাব আলাউদ্দিন খিলজিকে উপহার দেন। সাহিত্য ও সংগীতানুরাগী নবাব দিবসের কর্ম শেষে সন্ধ্যার পর প্রিয় সভাসদ সংগীতজ্ঞ আমির খসরু কর্তৃক উর্দুভাষায় রচিত গজল [ Ghazal ] শুনে মুগ্ধ হতেন।

পরবর্তী সময়ে বহু সংগীতগুণীজন অসংখ্য গজল [ Ghazal ] রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ইতিহাসখ্যাত গীতিকবি মির্জা গালিব, সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, লক্ষ্ণৌর নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ, সংগীতজ্ঞ নায়ক আরজু, কবি জওক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

গজল [ Ghazal ] গানে স্থায়ী এবং একাধিক অন্তরার প্রচলন রয়েছে। প্রথম অন্তরার মতোই অন্য অন্তরাগুলোও একই সুরভিত্তিক এবং ঠুংরি ও টপ্পাশৈলীর অনুসরণে গাওয়া হয়ে থাকে। সাধারণত উচ্চভাব ও গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে রচিত বলে গজল [ Ghazal ] শিল্পীর ভাষাজ্ঞান উন্নত হওয়া প্রয়োজন। কেননা এই শ্রেণির গানে সুরের চেয়ে বাণীর প্রাধান্য বেশি থাকে।

গজলে ব্যবহৃত রাগ ও তাল:

গজল [ Ghazal ] প্রধানত কাফি, ঝিঁঝিট, খাম্বাজ, ভৈরবী, পিলু, বারোয়া ইত্যাদি ধরণের হালকা রাগে গাওয়া হয়ে থাকে। তবে অনেক বড় ওস্তাদ পণ্ডিতগন অনেকগুলো গম্ভীর বা বড় বা সিরিয়াস রাগেও গজল [ Ghazal ] কম্পোজ করেছেন। এই গানের সঙ্গে দীপচন্দী, দাদরা, রূপক, পস্তো ইত্যাদি তালের সংগত পরিলক্ষিত হয়। এর একটি ভিন্নধর্মী আবেদন রয়েছে, যা শ্রোতার হৃদয়কে রসাপ্লুত করে তোলে। তাই এ শ্রেণির গান সবসময়ই যথেষ্ট জনপ্রিয়তার সঙ্গে দর্শক-শ্রোতার কাছে সমাদৃত। গজলে রাগ ব্যবহারের কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক:

  • কু বা কু ফ্যায়ল গায়ী বাত শানাসায়ি কি, উসনে খুশবু কি তারাহ মেরি পাজিরাই কি [ রাগ দরবারী ]
  • সুনতে হেয় মিল যাতিহে হার চিজ দুয়াসে, এক রোজ তুমেহ মাংকে দেখেঙ্গে খুদাসে [ রাগ দরবারী]
  • জিন্দগি মেয় সাবহি পেয়ার কিয়া কারতে হ্যায়, ম্যায় তো মারকার মেরি জান তুঝে চাহুঙ্গা [ রাগ : ইমন]
  • শোলা থা জ্বাল বুঝা হু, হাওয়ায়ে মুঝে না দো [ রাগ কিরউয়ানি]

 

গজলের ছন্দ ও কারিগরি বিষয় :

গজল [ Ghazal ] হচ্ছে দুই লাইনের কবিতা বা কাপলেট। প্রতিটি কাপলেট একটি করে “মিসরা”। একটি পুরো পুরো গজল [ Ghazal ] ( বা কাপলেট সমগ্রের) প্রতিটি কাপলেট বা মিসরা একটি করে স্বাধীন ও এক কবিতা হতে পারে। অর্থাৎ আগের কাপলেট বা মিসরার সাথে, তার পরের কাপলেট বা মিসরার সম্পর্ক থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। গজলের ছন্দ, রাদিফ বা মিটার আমাদের ছড়াকবিতা থেকে কিছুটা আলাদা।

“মিসাল কি তর পে” বা উদাহরণ সরূপ মির্জা গালিবের একটা গজলের কারিগরি বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

“দিলে নাদান তুঝে হুয়া কিয়া হ্যায়,
আখির ইস দারদ কা দাওয়া কিয়া হ্যায়”

একটু খেয়াল করে দেখুন এই দুটি লাইন কে যোগ করা হয়েছে “কিয়া হ্যায়” শব্দদুটো দিয়ে। এই ছন্দ মেলাতে সহায়তা করে যে শব্দ, তাকে বলা হয় “রাদিফ“। আর মুল যে ছন্দের বাঁধন, যেটা “হুয়া” বা “দাওয়া” দিয়ে করা হয়েছে, যেটা প্রতিটি লাইনে বদলে যাচ্ছে, এটাকে বলে “কাফিয়া”।

বাংলা ভাষায় গজল [ Ghazal ] :

বাংলা ভাষাতেও বহু গজল [ Ghazal ] রচিত হয়েছে, আর এ ব্যাপারে গীতিকবি কাজী নজরুল ইসলাম হচ্ছেন প্রথম পথপ্রদর্শক। তাঁর রচিত সুবিখ্যাত প্রথম বাংলা গজলটি উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হলো –

বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে, দিসনে আজি দোল।

আজো তার ফুল-কলিদের ঘুম টুটেনি, তন্দ্রাতে বিলোল ॥

আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায় ঝুরছে নিশি দিন।

আসেনি দখিনে হাওয়া গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল ॥

কবে সে ফুলকুমারী ঘোমটা চিরি, আসিবে বাহিরে।

শিশিরের স্পর্শ সুখে ভাঙবে রে ঘুম, রাঙবে রে কপোল ॥

ফাগুনের মুকুল জাগা দু’কূল ভাঙ্গা, আসবে ফুলেল বান, কুঁড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটবে হাসি ফুটবে গালে টোল ॥

কৰি তুই গন্ধে ভুলে ডুবলি জলে, কূল পেলিনে আর, ফুলে তোর বুক ভরেছিস আজকে জলে, ভরবে রে আঁখি কোল |

[গীতিকার : কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পী: কে মল্লিক (প্রথম বাংলা গজ.ল), তাল: কাহারবী (৮ মাত্রা), রেকর্ড : এইচএমভি, সেপ্টেম্বর ১৯২৮ নং : পি-১১৫১৮, কৃষ্ণনগর, ৮ অগ্রহায়ণ ১৩০০ বঙ্গাব্দ |

গজল [ Ghazal, Ghazals ] গজল গান ও কবিতা - সঙ্গীত শৈলী [ Music Genre ]
গজল, গজল গান ও কবিতা

আরও পড়ুন :