কবি বা লহর কবি গান [ Kabi or Lahar – Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ] : এই শ্রেণির গান থেকে কবিগানের নামকরণ। কেউ বলেন লহর কবি গান নাকি এক সময়ে এটি কবিগানের মূল অংশ ছিলো বলে এই শ্রেণির গানের নাম কবি। তবে সেটা সঠিক করে বলা মুশকিল। সাধারণত সমকালীন বা পৌরাণিক কোনো কাহিনির উপর নির্ভর করে লহর কবি বা এই জাতীয় গান রচনা করা হয়। বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি এমনকি জড়পদার্থ পর্যন্ত লহর কবি বা এই শ্রেণির গানের বিষয় হয়ে থাকে। বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, লহর কবি গানের কথা, উপস্থাপন ও সুর সবকিছুই হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়।
https://www.youtube.com/watch?v=4Khzcwgdx_E
লহর কবি বা কবিগানের বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও স্থূলরুচির যেসব অভিযোগ রয়েছে, এই জাতীয় গানের বিষয়বস্তু তার জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে হয়। বিশেষভাবে কলকাতা পর্বে এই জাতীয় গানের চাপান ও উতোরের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ আদিরসের আগমন ঘটতো।
প্রসঙ্গত উনিশ শতকের কলকাতার বিখ্যাত কবিয়াল হরু ঠাকুরের কবিগানের উল্লেখ করা যেতে পারে। জানা যায়, তিনি জমিদার নবকৃষ্ণ রায়ের অনুরোধে যেসব কবি রচনা করতেন, তার অধিকাংশই ছিলো জমিদার গৃহিণীদের নিয়ে নানা ধরনের আদিরসাত্মক উক্তি ও ইঙ্গিতমূলক। ১০ পূর্ববঙ্গ পর্বে তা খানিকটা হ্রাস পেলেও, একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
লহর কবি গান:
জবাবসহ একটি কবি উদ্ধৃত করা হলো, মূল গানটি বিজয়কৃষ্ণ সরকারের এবং এর জবাব গানটি স্বরূপেন্দু সরকারের:
বিজয়কৃষ্ণ সরকার রচিত ‘বেয়াইর বিয়ের কবি’:
চিতান একজন গরিব মানুষ কেশব ভুঁইয়ে সন্ধ্যার পর বিছানায় শুইয়ে দীনতায় হীনতায় পূর্ণ মন।
[ ৯ মীর মশাররফ হোসেন, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী,’ মশাররফ রচনা সম্ভার, ৩য় খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪), পৃ. ৪২। ১০ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৪র্থ খণ্ড (কলকাতা: মডার্ন বুক এজেন্সি, ১৯৭৩), পৃ. ১৬০। ]
পাড়ন অনেক চিন্তার পরে বুড়ো বরে কন্যা দিতে চায় সংসারের দায় নয়শো টাকা পণ ॥
১ম ফুকার ও সেই খবর পেয়ে বর জুটলো এক কজ্জল বর্ণের লজ্জাহীন বজ্জাত। ও তার ছেলে মেয়ে আছে ঘরে বউ মরছে হঠাৎ । বয়স প্রায় ষাটের ঊর্ধ্বে হার মেনেছে সংসার যুদ্ধে ভোগে আম-বাত রোগে মধ্যে মধ্যে পড়ে গেছে নীচের পাটির দাঁত ॥
মিশ সেই মেয়ের বয়স চোদ্দো বছর সংবাদ পেয়ে তাই। নিমাই বালা বরের বেয়াই বরকে দেয় মিঠেকড়া সান্ত্বনা।
মুখ বেয়াই হে করি মানা এমন শরিকনাশা জরিমানা দিতে যেয়ো না ॥
প্যাঁচ তুমি টাকা দিলে হাজার খানেক বন্ধুবান্ধব নিন্দে তোমায় করবে অনেক টাকায় কি যৌবন পাওয়া যায় । হলে দোয়াজবরে কন্যা কিছু মানাতো তোমায়। ভাবে থাকিলে সমতা প্রাণে আসে মমতা বেয়াই তোমার নাই কোনো ক্ষমতা না বুঝে ভাবছাড়া লাফ দিয়ো না ॥
খোচ আমি তোমার আত্মীয় পর ভাবিয়ো না
২য় ফুকার বয়স পঞ্চাশ ঊর্ধ্বে বনং ব্রজেৎ ধর্মশাস্ত্রের মর্ম তোমায় কই। হবে যোগে যুক্ত বিষয়মুক্ত স্বভাবে কালজয়ী। দিনে দিনে দিন ফুরালো কাল পেয়ে কাল ঘনালো তোমার চুল পাকিলো দাঁত পড়িলো বেহাই তোমার তা পাকিলো কই।
মিশ মোহের উন্মাদনায় সেজেছো ভাই উন্মুক্ত বারণ। তোমায় বারে বারে করি বারণ মরণপথে চরণ আর বাড়াইয়ো না ॥
অন্তরা তোমার এই সখের জাল সাপের মাল সাধ করে গলেতে পরিয়ো না। তুমি যন্ত্রহারা মন্ত্রহারা গো, ভুল করে এই মরণ মরিয়ো না। তোমার পাক চুলেতে কলপ দিয়ে কালো করলে ভাই টাক বন্ধ করিবার কোনো ব্যবস্থা তো নাই। তার তো ঔষধ মেলে না। তুমি বাহিরে যতো সাজ পরো গো মন্ত্রের কাজ চোখ ঘুল্লিতে সারে না। নারীর চক্র ভীষণ চক্র বোঝা খুব মুশকিল তোমায় মুখে যেটুক ভালোবাসবে দিয়ে গোজামিল তাতো তুমি বুঝবে না। ব্রজের আয়ান ঘোষের দশা যেমন গো পরে খায় ঘরের সব মাখন ছানা ।।
পরচিতান যতো জ্ঞানী মানুষ ধরাতলে দেশকালপাত্র ভেদে চলে। বেদে কয় সুপণ্ডিত তারে।
পরপাড়ন কতো বোকা লোকে টাকার জোরে সাজে বুদ্ধিমান তুমি তার প্রমাণ দিলে এবারে ॥
শেষ ফুকার কেন বার্ধক্যে ষোড়শী এনে বড়শি গলে বিধতে চাও। তোমার বড়ো ছেলের বিয়ের বয়স তারে বিয়ে দাও। সংসারের বিষম বিষে এ জ্বালা জুড়াবে কিসে নিয়ে সৎ গুরুর সৎ পরামিশে দেশের মানুষ দেশে চলে যাও ॥
বিজয়কৃষ্ণ সরকারের এই ‘বেয়াইর বিয়ের কবি’-র স্বরূপেন্দু সরকার রচিত জবাব:
চিতান/ বেয়াই নিমাই বালা বুদ্ধির ঢেঁকি, বল দেখি বিয়ের বুঝিস কী।
পরপাড়ন/ আমার টাকাপয়সা যাবে না সাথে, তাই বিয়েতে সুখ করে রাখি ।।
ফুকার/ তুমি বুড়া মানুষ দেখে কেন করতেছ তামাশা এতো জানো না শক্তি মোর কতো।
শিখেছি বাণের ভজন, যৌবনশক্তি রসায়ন বেয়াই তারও খেয়ে তিন চার ডজন হয়েছি ঠিক যুবকের মতো ॥
মিশ/ বেয়াই বৃদ্ধ মানুষ দেখে কেন করছো উপহাস।
আমার গায়ে লেগে বসন্তের বাতাস যৌবনের মৌবনে নিয়েছি ঠাই।
বেয়াই হে করি মানা, আমার বিয়েতে বাদ সাধিও না বেয়ানের দোহাই ॥
প্যাঁচ/ আছে ইতিহাসে পুরাকালে অনেকে বিয়ে করতো বুড়াকালে তাহাতে কম পড়তো না বল।
হতো প্রাণায়ামে আয়ু বৃদ্ধি যৌগিক ক্রিয়ার ফল।
দেখো হক সাহেব বরিশালে আশি বছরের কালে ও তার দিব্য ছেলে জন্ম নিলে ঈশ্বর কি আমাকে করবে না তাই ॥
খোচ/ তোমার কথা শুনে আমার দুঃখের সীমা নাই ॥
২য় ফুকার/ দেখো আরবে মাবিয়া ছিলো বয়স তার সাড়ে চার কুড়ি।
বউ ছিলো আশি বছরের বুড়ি।
তার কাছে একদিন গিয়ে এজিদকে জন্মাইয়ে দিলো এমাম বংশের মাথা খেয়ে, তার সাথে দেবো আজ আড়ি ॥
৩য় ফুকার/ বললে বেয়াইর নাই কোনো ক্ষমতা, এ কথায় বড়ো ব্যথা পাই। ক্ষমতা কোনখানে দেখাই।
বেয়াই মোর কথা নিয়ো আর বুঝি এসব কইয়ো। আমার বেয়ানকে পাঠায়ে দিয়ো শক্তির পরীক্ষা দিতে চাই ॥
৪র্থ ফুকার/ বললে বড়ো ছেলের বিয়ের বয়স, বেয়াই তুমি তারে বিয়ে দাও।
এ কেমন কথা কও। ছেলে পাস করুক বিএ, তারপরে দেবো বিয়ে তারে বিএ-র আগে বিয়ে দিয়ে ছেলের কি মাথা খেতে চাও।।
৫ম ফুকার/ নীচের পাটির দাঁত পড়েছে, এ কথায় বাধালে জঞ্জাল খুলনা কি গিয়ে বরিশাল গিয়ে ডেন্টিস্টের ধারে, নতুন দাঁত দেবো জুড়ে শেষে বেয়ান যদি দর্শন করে, শেষকালে পুড়বে তোমার কপাল ॥
১১ [১১ উদ্ধৃত, স্বরোচিষ সরকার, “কবিগান: অতীত ও বর্তমান,” সাহিত্য পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫, পৃ. ২১৩–১৭।]
লহর কবি এবং কবির লহরে বিশেষ তফাত রয়েছে বলে মনে হয়। লহর কবি বলতে সাধারণত প্রতিযোগিতামূলক গান বোঝানো হয়। যখন কোনো মালশির জবাবে প্রতিপক্ষের মালশি গাওয়ার প্রয়োজন হতো, তখন তাও লহর মালশি নামে পরিচিত হতো। অন্যদিকে কবির লহর মানে হলো জোটের পাল্লা, যেখানে উভয় কবিয়াল সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ছড়া কেটে বিতর্ক করে থাকেন। আসলে লহর শব্দটি লড়াইয়ের সমার্থক। তাই উনিশ শতক থেকে কবিগানের একাধিক অঙ্গের সঙ্গে লহর শব্দটি যুক্ত হয়ে আছে।
লেখক :
স্বরোচিষ সরকার [ Shorochish Sarkar]
বিশিষ্ট আভিধানিক ও বৈয়াকরণ
অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
লেখক : কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি
এই বিষয়ে অন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলগুলো দেখুন :
16 thoughts on “কবি বা লহর কবি গান [ Kabi or Lahar – Kavigan, Kobi Gaan, Kobi Lorai or Kabigan ]”