কবিগানের কাল ও উপলক্ষ

কবিগানের কাল ও উপলক্ষ : সাধারণত আশ্বিন মাস থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত কবিগানের জন্য প্রশস্ত সময়। এই সময় বাঙালির যাবতীয় উৎসব-অনুষ্ঠান, এমনকি বাঙালি হিন্দুদের পূজাপার্বণেরও সময়। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্ভবত এর মূল কারণ। জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চার মাসে ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এর ফলে এই সময়ে গ্রামীণ অনুষ্ঠানসমূহ নির্ঝঞ্ঝাট হয় না। কবিগানের মতো সঙ্গীতানুষ্ঠান যাঁরা উপভোগ করে থাকেন, সেই শ্রোতামণ্ডলীর সিংহভাগ অংশ এই কালপর্বে কৃষিকাজের সঙ্গে এতোটা নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকেন যে, কোনো ধরনের বিনোদনের সুযোগ তাঁদের থাকে না। কবিগানের এই কালপর্ব বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্র এক রকম। তবে শহর এলাকার পরিবেশ, সুযোগ ও শ্রোতাদের কর্মসময় ভিন্ন থাকার কারণে অনেক সময়ে উল্লিখিত বর্ষাকালেও কবিগানের আয়োজন হয়ে থাকে।

কবিগানের কাল ও উপলক্ষ

 

কবিগানের নির্দিষ্ট কোনো আসরের কালপরিধি পালা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ধারণা করা হয় যে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো একটি পালা পরিবেশিত হতে কমবেশি ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই হিসেবে ভোররাত চারটার সময়ে কোনো গান শুরু হলে সাধারণত বিকেল চারটার দিকে তা শেষ হয়। কবিগানের অনেকগুলো পর্যায় আছে, সেগুলোর কালপরিধিও কমবেশি আন্দাজ করা সম্ভব। টপ্পা, পাঁচালি, ধুয়া, ও জোটের পাল্লার জন্য কমবেশি ছয় ঘণ্টা সময়ের দরকার হয়। বাকি ছয় ঘণ্টার মধ্যে কমবেশি এক ঘণ্টা ব্যয় হয় দুই দলের ডাক ও মালশি গানের জন্য, কমবেশি দুই ঘণ্টা ব্যয় হয় দুই দলের সখীসংবাদের জন্য, এবং কমবেশি তিন ঘণ্টা ব্যয় হয় কবি বা লহর কবির জন্য।

কবিগানের কাল ও উপলক্ষ, কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি - স্বরোচিষ সরকার
কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি – স্বরোচিষ সরকার

বিশ শতকের শেষার্ধ থেকে কবিগানের এই কালপরিধিতে নানা রকম পরিবর্তন ঘটে। কবিগানের আসর যেহেতু আর একমাত্র চণ্ডীমণ্ডপকে কেন্দ্র করে আবর্তিত থাকে না, সেহেতু কবিগান পরিবেশনের সময়ও পূজার সময়ের থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। তখন এক এক অঞ্চলে দেখা যায় এক এক রকম সময়ক্রম।

একুশ শতকের সূচনায় তথ্যসংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় একটি আসর শুরু হয়েছিলো দুপুর তিনটায়, বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের সাতপাড়ে একটি আসর শুরু হয় সন্ধ্যা নাগাদ, ঢাকা শহরের জেলেপাড়ার কবিগানের আসর শুরু হয় বিকেল চারটায়, আবার একটি অডিটরিয়মে অন্য একটি অনুষ্ঠানের শেষে রাত দশটায় কবিগান শুরু হয়। উল্লিখিত আসরগুলোর মূল আকর্ষণ ছিলো ধুয়া ও পাঁচালি। সাতপাড় এবং ঢাকার জেলেপাড়ার আসরে ডাক-মালশি, সখীসংবাদ ও টপ্পা শোনা গেলেও অধিকাংশ আসর শুধু ধুয়া ও পাঁচালিতে সীমাবদ্ধ ছিলো। শেষোক্ত আসরগুলোর কালপরিধি কোনোটা দুই ঘণ্টার, এবং সবচেয়ে দীর্ঘটা পাঁচ ঘণ্টার।

সূচনালগ্ন থেকে কবিগানে উপস্থাপিত বিষয়ের মধ্যে শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় ধারণার মিশ্রণ এবং সহাবস্থান লক্ষণীয়। এর কারণ সম্ভবত এই যে, কবিগানের উদ্ভবকালে বাঙালি হিন্দুর ধর্মবিশ্বাসে এই দুই ধারা বিশেষভাবে প্রবল ছিলো। তবে উল্লিখিত মিশ্রণ ও সহাবস্থান যেমন সমকালীন শ্রোতাদের মানস-গঠনকে প্রতিনিধিত্ব করে, একইভাবে এটাও প্রমাণ করে যে, এই দুই ধারার কোনোটার সঙ্গে কবিগান অনুগত ছিলো না। কেননা সাধারণত যেমনটা দেখা যায়, বিশেষ কোনো ধর্মের অনুষঙ্গী সঙ্গীতে কখনোই ভিন্ন মতাদর্শের কোনো স্থান থাকে না। অন্যদিকে কবিগানে শাক্ত ও বৈষ্ণবীয় অনুষঙ্গ যুগপৎ সমান গুরুত্বের সঙ্গে থাকায় এবং পরবর্তী কালে আরো অনেক আদর্শ ও ধারণা এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায়, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, সূচনালগ্ন থেকে কবিগানের গঠন বারোয়ারি প্রকৃতির।

কবিগানের কাল ও উপলক্ষ

 

কবিগানের এই বারোয়ারি বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে যে কোনো ধরনের গ্রামীণ উৎসব-অনুষ্ঠানে কবিগান একটি সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিনোদনের উপায়ে পরিণত হয়। একই কারণে বিভিন্ন ধরনের বারোয়ারি পূজা-অনুষ্ঠান ও তৎসংশ্লিষ্ট মেলায় কবিগানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিশেষভাবে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, রাসযাত্রা, মকর সংক্রান্তি, সরস্বতী পূজা, মাঘী পূর্ণিমা, দোলযাত্রা, বারুণী স্নান, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষ প্রভৃতি উপলক্ষে বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে এক দিন থেকে শুরু করে দুই সপ্তাহব্যাপী যেসব মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে, কবিগান থাকে তার মধ্যে প্রধান একটি আকর্ষণ। আজকাল রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মর্যাদা বৃদ্ধি ও লোক-সমাগম বৃদ্ধির লক্ষ্যেও কবিগানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল কবিগানকে তাঁদের প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। বিশেষভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ পরিকল্পিতভাবে একাধিক কবিয়ালকে তাঁদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। এর ফলে রমেশ শীল প্রমুখ কবিয়াল কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন সভা-সমাবেশ উপলক্ষে কবিগান পরিবেশন করতে শুরু করেন। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কবিগান অনুষ্ঠিত হয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারি কর্মসূচিই উপলক্ষ, তার সময়কালও সুনির্দিষ্ট। বিশ শতকের শেষার্ধে রেডিও এবং টেলিভিশনে কবিগান অনুষ্ঠান প্রচার হতে শুরু করে। সেসব অনুষ্ঠানের জন্যও বিশেষ কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন হয় না।

কবিগানের এই রাজনৈতিক ব্যবহার একুশ শতকের সূচনায় পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় অব্যাহত দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের মহিলা কবিয়াল উমা সরকার যেমনটা জানান, ত্রিপুরা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে তাঁকে সেখানে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে কবিগানে অংশ নিতে যেতে হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত খ্যাতিমান মন্ত্রী কবি অনিল সরকারও তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর এই কৌশলের কথা এবং এই কৌশলে কাজ হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, নির্বাচনের পূর্বে অন্য নেতাদের মতো গতানুগতিক জনসভা তিনি করেন না। তাঁর জনসভায় নানা ধরনের লোকসঙ্গীতের আয়োজন থাকে। লোকসঙ্গীতের মধ্যে বিশেষ কোনো সংলাপ রসোত্তীর্ণ হতে পারলে, তা সাধারণ প্রচারণার চেয়ে অনেক বেশি কাজ দেয়। শিল্পী যখন ‘খাবে যা বন্ধিলারে খা’ বলে গান ধরে, সাধারণ মানুষ তখন বুঝে নেয়, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

রেফারেক্স:

স্বরোচিষ সরকার, “কবিগানের অতীত বর্তমান ও রূপান্তরের ধারা,” বাংলা একাডেমী পত্রিকা, ৩৯তম খণ্ড ১ম সংখ্যা, ১৯৯৫, পৃ. ৫৮।
যেমন বিশ শতকের ত্রিশের দশকে রাজেন্দ্রনাথ সরকার তাঁর সহযোগীদের নিয়ে পানসি নৌকায় করে কলকাতায় যেতেন। দ্রষ্টব্য, জসীমউদ্দীন, জীবনকথা (পুনর্মুদ্রণ; ঢাকা: পলাশ প্রকাশনী, ২০০৩), পৃ. ১২৫।

[ কবিগানের কাল ও উপলক্ষ ]

আরও দেখুন:

1 thought on “কবিগানের কাল ও উপলক্ষ”

Leave a Comment