কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর [ History, Geography and Transformation of Kavigan ] : বিশেষ কোনো লোকসঙ্গীত বিশেষ কোনো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, এমনকি তার বিকাশও ঘটে নির্দিষ্ট কোনো এলাকাকে ঘিরে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি লোকসঙ্গীতের আঞ্চলিক ভূগোলের উল্লেখ করা যায়: যেমন উত্তরবঙ্গ ভাওয়াইয়া, মধ্যবঙ্গ বাউল এবং পূর্ববঙ্গ ভাটিয়ালি গানের অঞ্চল। কবিগানের ভৌগোলিকতা এমন সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায় না। তবে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ কোনো ভৌগোঋএলিক অঞ্চলকে কবিগান চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কবিগানের উদ্ভবপর্বে বিশেষভাবে আঠারো শতকে কবিগান পরিবেশন করেছিলেন বলে যাদের নাম পাওয়া যায়, তাঁদের অধিকাংশের জন্মস্থান বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলি প্রভৃতি অঞ্চলে। [৫]

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর - কবিগানের আসর [ কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি ] কবিগানের ইতিহাস, কবিগানের ভূগোল ও কবিগানের রূপান্তর
কবিগানের আসর [ কবিগানের স্বরূপ ও প্রকৃতি ] স্বরোচিষ সরকার
এ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে রাঢ় অঞ্চলকে ঘিরেই কবিগানের উদ্ভব ঘটেছিলো। এর অব্যবহিত পরে অর্থাৎ উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা জুড়ে কলকাতাই হয়ে উঠেছিলো কবিগানের লালন ও চর্চার কেন্দ্রভূমি। সমকালীন জমিদারদের কল্যাণে এ সময়ের কবিগান বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বিশ শতক নাগাদ দেখা যায় কবিগান কলকাতা থেকে প্রায় নিঃশেষিত হয়ে আসছে এবং প্রধানত পূর্ববঙ্গের কয়েকটি অঞ্চলে এর চর্চা সীমাবদ্ধ থাকছে। আবার বিশ শতকের শেষ দিকে এসে গঠনগত বৈচিত্র্য সত্ত্বেও কবিগানকে পাওয়া যায় বাংলাভাষী প্রায় সব অঞ্চলে এভাবে কালপরিক্রমায় কবিগানের ভূগোলে বেশ বড়ো ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। বাংলার অন্য কোনো লোকসঙ্গীতের ভূগোল ঠিক এতোটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় না।

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর
কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর

কবিগানের এই ভূগোলকে কাল ও স্থানসাপেক্ষে বড়ো ধরনের মোট চারটি ভাগে বিভক্ত করে দেখা যায়। প্রথমত রাঢ় অঞ্চল, দ্বিতীয়ত কলকাতা অঞ্চল, তৃতীয়ত পূর্ববঙ্গ অঞ্চল, এবং চতুর্থত অনুবর্তন কালীন সম্পূর্ণ বাংলাভাষী অঞ্চল।

রাঢ় অঞ্চলে উদ্ভূত এই কবিগানের গুণগত মান উনিশ শতকের সমৃদ্ধ কলকাতার শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে থাকবে। শ্রোতাদের সমৃদ্ধি গায়কের সমৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলার কারণে কলকাতা এবং এর নিকটবর্তী অঞ্চলের অনেকে কবিগানের পেশায় আসতে শুরু করেছিলেন। এ সময়ে এই পেশার সঙ্গে যাঁরা নিজেদের জড়িত করেছিলেন, তাঁদের বেশ বড়ো একটি অংশ আর্থিকভাবে বিত্তবান, এমনকি সামাজিকভাবেও মর্যাদাবান ছিলেন। গোঁজলা গুই এবং তাঁর প্রধান শিষ্যের পদবি দেখে বোঝা যায়, তাঁরা কেউ ব্রাহ্মণ ছিলেন না। কবিগান কলকাতায় স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে কবিয়ালদের বিত্ত ও সামাজিক মর্যাদায় পরিবর্তন ঘটে। অনেক ভূস্বামী শখের দল গঠন করেন, অনেক ব্রাহ্মণ-সন্তান এই পেশায় এগিয়ে আসেন, এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার একাধিক ফিরিঙ্গিকেও এই পেশা আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।

 

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর
কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর

 

উনিশ শতকে কলকাতার যেসব এলাকায় কবিগানের আসর বসতো তার মধ্যে শোভাবাজার, বাগবাজার, জোড়াসাঁকো, বউবাজার, তারকেশ্বর, বরানগর, কাশিমবাজার প্রভৃতি এলাকার নাম বিশেষভাবে অবগত হওয়া যায়। এ সময়ে চন্দননগর (ফরাসডাঙা), চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, সপ্তগ্রাম, বীরভূম জেলার সিউড়ি, নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর প্রভৃতি অঞ্চলেও কবিগান চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। পাশাপাশি কলকাতার জমিদারদের মফস্বলের জমিদারি এলাকাগুলোতেও কবিগান পরিবেশিত হতে শুরু করে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অন্যতম খ্যাতিমান কবিয়াল ভোলা ময়রা এই সূত্রে প্রায় নিয়মিতভাবেই চব্বিশ পরগনা, হুগলি, মেদিনীপুর, হাওড়া, বাঁকুড়া, নদীয়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় কবিগান পরিবেশন করতেন।

কবিগানে আবশ্যিকভাবেই যেহেতু দুইজন কবিয়াল ও দুইটি কবির দলের প্রয়োজন, সেহেতু এমন অনুমান খুবই স্বাভাবিক যে, ভোলা ময়রার প্রতিদ্বন্দ্বী কবিয়ালগণকেও ঐসব অঞ্চলে গিয়ে গান পরিবেশন করতে হয়েছে। কলকাতার এই কবিয়ালদের গ্রামবাংলায় নিয়মিত আগমনের ফলে যে শ্রোতৃমণ্ডলী তৈরি হয়, সেই শ্রোতৃমণ্ডলীর ক্রমবর্ধমান চাহিদাই গ্রামবাংলায় নতুন নতুন কবিয়ালের জন্ম হতে থাকে। উনিশ শতকের শেষার্ধ নাগাদ কবিগান এভাবে সমস্ত বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বিশ শতকের সূচনায় অন্যান্য বিনোদন মাধ্যমের প্রতি শ্রোতৃমণ্ডলীর আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে খোদ কলকাতা থেকে কবিগান লোপ পেতে শুরু করে।

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর
কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর

সঙ্গত কারণে মফস্বলে তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের সব অঞ্চল থেকে লুপ্ত হতে শুরু করলেও ঠিক এই সময়ে পূর্ববঙ্গের একাধিক অঞ্চলে কবিগান নতুনভাবে উজ্জীবিত হয় এবং পুরো বিশ শতক জুড়ে পূর্ববঙ্গে কবিগানের চর্চা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে হতে থাকে।

– কবিগানের এই বিশ শতক পর্ব প্রধানত পূর্ববঙ্গকেন্দ্রিক। বৃহত্তর ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর জেলায় এ সময়ে কবিগানের চর্চা অব্যাহত থাকে এবং অনেক প্রতিভাবান কবিয়ালের জন্ম হয়। বিশ শতকের পূর্ববঙ্গের এই কবিগানেও একাধিক আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঢাকা-ময়মনসিংহ অঞ্চলের কবিগানের সঙ্গে খুলনা বরিশাল অঞ্চলের কবিগানের পার্থক্য সৃষ্টি হয়।

https://youtu.be/Ktj4Lvhmj0w

এই সময়ে পূর্ববঙ্গের যেসব অঞ্চলে কবিগান সর্বাধিক চর্চিত হয়, তার মধ্যে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, জয়দেবপুর (গাজিপুর), চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ), বরিশাল, ঝালোকাঠি, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, নড়াইল প্রভৃতি অঞ্চলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে কবিগানের অন্তত দুটি কেন্দ্রের নাম আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। একটি হলো ঝালোকাঠি। এখানে অনেকগুলো কবিগানের দল ছিলো, কবিয়াল এবং দোহারগণ কবিগানের মৌসুম শুরু হওয়ার সূচনায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে এসে জড়ো হতেন। অন্যটি ঢাকার সদরঘাট এলাকা। দুর্গা পূজা শুরু হওয়ার আগেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পানসি নৌকা করে কবিয়ালগণ তাঁদের দলবলসহ এখানে এসে জড় হতেন।

কবিগানের আসরে কবিয়াল এবং দোহারগণ মিলে যা পরিবেশন করে থাকেন, তাকে প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে : এক. গান; এবং দুই. ছড়া। আকারের দিক দিয়ে গানগুলোকে হ্রস্ব ও দীর্ঘ—এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তবে সুরের দিক দিয়ে গানগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রভৃতি নানা শাখার গান যেমন কবিগানে এসে মিশেছে, তেমনি বাংলাদেশের লোকযাত্রা ও লৌকিক ধরনের কথকতার এক ধরনের সমন্বয় কবিগানে ঘটেছে। এই মিশ্রণ ও সমন্বয় কোনো একজনের হাতে বা কোনো এক বিশেষ এলাকায় বা কোনো নির্দিষ্ট কালপর্বে হঠাৎ করে সৃষ্টি হয়েছিলো, এমন মনে হয় না।

কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর
কবিগানের ইতিহাস, ভূগোল ও রূপান্তর

হয়তো ধীরে ধীরে বিভিন্ন এলাকার কবিয়ালদের আলাদা আলাদা উদ্যোগের মাধ্যমে কবিগান তার এই বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিক ও প্রকরণ অর্জন করেছে। সেই সঙ্গে এ কথা হয়তো বলা যায় যে, কবিগান নামের যে কাঠামো আঠারো শতকের নিকটবর্তী সময়ে উদ্ভূত হয়েছিলো, প্রথম থেকেই তার মধ্যে যাবতীয় লোকসঙ্গীত ও লোকনাট্যিক উপাদান ধারণ করার মতো চরিত্রবৈশিষ্ট্য নিয়েই সে জন্মেছিলো। এ জাতীয় গানের কোনো উদাহরণ বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই মনে হয়, আঠারো শতকে কলকাতার অভূতপূর্ব পরিবেশই কবিগানের মতো এমন জটিল একটি সঙ্গীতশৈলী উদ্ভবের সবচেয়ে বড়ো কারণ।

[ কবিগানের ইতিহাস, কবিগানের ভূগোল ও কবিগানের রূপান্তর ]

৫° দীনেশচন্দ্র সিংহ, পূর্ববঙ্গের কবিয়াল কবি-সঙ্গীত, পৃ. ২৯১। যেমন গৌজলা গুই এবং তাঁর প্রধান তিন শিষ্য লালু নন্দলাল, রামজী দাস ও রঘুনাথ দাসের জন্মস্থানের জন্য পরিশিষ্ট ১ দ্রষ্টব্য।
প্রফুল্লচন্দ্র পাল, প্রাচীন কবিওয়ালার গান, পৃ. নয়।
৫৭ ধর্মানন্দ মহাভারতী, “ভোলা ময়রা,” সাহিত্য সংহিতা (কলকাতা), মার্চ-এপ্রিল ১৯০৫, পৃ. ৬৫৮। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২২১।

আরও পড়ুন: